বিনোদন
Trending

শাকিবের ‘বরবাদ’ আরও ভালো হতে পারত কি

লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রে শাকিব খান; ‘বরবাদ’ হয়ে রইল ঢাকাই সিনেমার নতুন এক মানদণ্ড

কয়েক বছর ধরেই পর্দায় নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন শাকিব খান। ‘প্রিয়তমা’ দিয়ে যে ‘নতুন শাকিব’-এর শুরু, গত বছর ‘তুফান’ দিয়ে সেই পরিচয়কে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘বরবাদ’ তিনি শুরু করেছেন ‘তুফান’-এর পরের ধাপ থেকেই। দুর্দান্ত অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি, ঝানু পার্শ্ব অভিনেতা, একের পর এক রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য আর অতি অবশ্যই লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রে শাকিব খান; ‘বরবাদ’ হয়ে রইল ঢাকাই সিনেমার নতুন এক মানদণ্ড।
‘বরবাদ’ মেহেদী হাসানের প্রথম সিনেমা। প্রথম সিনেমাতেই যে তিনি বাজিমাত করেছেন, সেটা এরই মধ্যে সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আপনার জেনে যাওয়ার কথা। বড় বাজেটের সিনেমা, তবে সিনেমার বাজেটকে পাশে সরিয়ে রাখলে পুরো কৃতিত্ব দিতে হয় পরিচালককে। কারণ, এত বাজেট ঠিকঠাক ব্যবহার করে এই স্কেলের সিনেমা বানানোও চাট্টিখানি কথা নয়।

একনজরে
সিনেমা: ‘বরবাদ’
জনরা: রোমান্টিক অ্যাকশন
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ১৯ মিনিট
পরিচালক: মেহেদী হাসান
অভিনয়: শাকিব খান, ইধিকা পাল, যীশু সেনগুপ্ত, মিশা সওদাগর, স্যাম ভট্টাচার্য

এবার আসা যাক ‘বরবাদ’-এর গল্পে। শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আদিব মির্জা (মিশা সওদাগর)। তাঁর একমাত্র ছেলে আরিয়ান মির্জা (শাকিব খান)। ছেলেই আদিব মির্জার সব। ছোটবেলা থেকেই আদরে আদরে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য এক ‘দানব’। হেন কোনো খারাপ কাজ ছিল না যা আরিয়ান করেনি। মাদক, নারী কেলেঙ্কারি, মারামারি—ইউটিউবে আরিয়ান মির্জাকে সার্চ করলে এমন অনেক কনটেন্ট আসে। কিন্তু ছেলের সব রকমের কুকর্ম সামলানোর জন্য আদিব মির্জা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সব সময়। তাই এত কিছু করার পরও আরিয়ানকে কেউ ছুঁতে পারত না।

পার্টিতে নেশা আর ফূর্তি করে প্রচুর টাকা ওড়ায় আরিয়ান। এমন এক পার্টিতে আরিয়ান মির্জার সঙ্গে দেখা হয় নিতুর (ইধিকা পাল)। পার্টি শেষে আরিয়ানের কাছে একটি দাতব্য সংস্থার জন্য সাহায্য চাইতে আসে নিতু। প্রথম দেখাতেই নিতুর প্রেমে পড়ে যায় আরিয়ান। তারপর শুরু হয় নিতুর ওপর তাঁর ‘ভালোবাসার অত্যাচার’। নিতুকে নিজের করে পেতে সে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। উপহারে উপহারে ভরিয়ে দেয় তাকে। অন্যদিকে নিতুকে কেউ অবহেলা করলে তার জীবন একনিমেষে তছনছ করতে ছাড়ে না আরিয়ান। কিন্তু এত কিছু করার পরও কি সে নিতুকে নিজের করে পায়? নাকি নিজেদের পাপে নিজেরাই আটকা পড়ে?

‘বরবাদ’ উন্মাদ প্রেম, সহিংসতা আর প্রতিশোধের গল্প। অ্যাকশন দৃশ্যে শাকিবের সহিংসতা দেখে গায়ে যেমন কাঁটা দেয়, তেমনি তাঁর পাগল করা ভালোবাসা চমকাতে বাধ্য করে। সিনেমার প্রথম দিকে শাকিব খান শুধু তাঁর এক্সপ্রেশন আর লুক দিয়েই টেনে নিয়ে গেছেন গল্পটা। আর গল্পের পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় হয়ে উঠেছেন আরও বেপরোয়া, খ্যাপাটে।

আজকাল বড় তারকার অনেক সিনেমাই গল্পনির্ভর না হয়ে বরং সিকোয়েন্স–নির্ভর। প্রতিটি দৃশ্য দেখে দর্শক যেন চমকে যায়, টান টান উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে, প্রিয় তারকাকে দেখে সিটি দেয়—‘বরবাদ’-এ এর সব বন্দোবস্তই রেখেছেন নির্মাতা। দম ফেলার ফুরসত নেই, একটার পর একটা দৃশ্য আসে আর উড়িয়ে নিয়ে যায়। বিরতির আগে যে টুইস্ট আসে, সেটাই চমকে দেওয়ার মতো। সব মিলিয়ে বিরতির আগপর্যন্ত গল্প বেশ জমাটি।

কিন্তু সিনেমার দ্বিতীয় অংশে পরপর অনেকগুলো ঘটনা দেখাতে গিয়ে মনে হয়েছে, তাড়াহুড়া করছেন নির্মাতা। অথচ ‘বরবাদ’ সিনেমার নির্মাণ এতটাই ভালো যে এই সিনেমা অনায়াসে আরও ঘণ্টাখানেক দেখতে পারতেন দর্শক।

এই সিনেমা যে বড় বাজেটে নির্মিত, প্রতিটি দৃশ্যেই সেটা স্পষ্ট। বিলাসবহুল গাড়ি, ঝাঁ–চকচকে সেট আর সিনেমার মেজাজই সেটা বলে দিচ্ছিল। তবে মুক্তির আগে যেভাবে ‘অমুক সিনেমার কপি’ বলে প্রচার চলছিল, সেটা সত্যি নয়। সিনেমার কিছু চরিত্র আর দৃশ্যে যে সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গার ‘অ্যানিমেল’ সিনেমার প্রভাব আছে, সেটা সত্যি। কিন্তু এটা তো নির্মাতা আগেই জানিয়েছেন।

আরিয়ান মির্জা চরিত্রে শাকিব খান দুর্দান্ত। এ সিনেমায় তাঁর লুক চমকে দেওয়ার মতো। শুরুর দিকের আরিয়ান মির্জা অথবা পরের লম্বা চুলের বিধ্বস্ত ও ক্ষুব্ধ আরিয়ান—দুই লুকেই দারুণভাবে মানিয়ে গেছেন তিনি। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতেও তাঁর পারফরম্যান্স ছিল চোখধাঁধানো।

শাকিবের নায়িকার চরিত্রে কলকাতার ইধিকা পালও দারুণ কাজ করেছেন। বাণিজ্যিক সিনেমার নায়িকা যে কেবল গ্ল্যামারনির্ভর নন, অভিনয়টাও ভালো জানতে হয়, ‘প্রিয়তমা’র পর এ ছবিতেও সেটা দেখিয়েছেন ইধিকা। সাধারণ চাকরিজীবী থেকে প্রতিশোধপরায়ণ তরুণী—সব রূপেই মানিয়ে গেছেন তিনি। ইধিকার সঙ্গে শাকিবের রসায়নও জমেছে বেশ। তবে ‘প্রিয়তমা’র চেয়ে উন্নতি হলেও ইধিকার উচ্চারণে এখনো কলকাতার টান রয়ে গেছে। একই কথা পর্দায় তাঁর বোনের চরিত্রে অভিনয় করা রিয়া গাঙ্গুলি চক্রবর্তীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

‘তুফান’-এর ছোট ছোট পার্শ্বচরিত্রে দেশের ঝানু সব অভিনয়শিল্পীকে দেখা গেছে। এ ছবিতেও সেটা আছে। পার্শ্বচরিত্রগুলোতে মামুনুর রশীদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান বাবু, ইন্তেখাব দিনার, নরেশ ভূঁইয়া, নাদের চৌধুরীরা যে যাঁর চরিত্রে ভালো করেছেন। আরিয়ানের বাবা আদিব মির্জার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিশা সওদাগর। মিশা সওদাগরের অভিনয় দেখে তাঁকে দর্শক নতুনভাবে চিনবেন। একজন পরিচালক চাইলে একজন অভিনেতার থেকে কতটা বের করে আনতে পারেন, মিশা সওদাগর এর উদাহরণ হয়ে থাকবেন।

‘বরবাদ’ ছবির ‘চাঁদ মামা’ গানের দৃশ্যে শাকিব খানের সঙ্গে নুসরাত জাহান
‘বরবাদ’ ছবির ‘চাঁদ মামা’ গানের দৃশ্যে শাকিব খানের সঙ্গে নুসরাত জাহানছবি : ফেসবুক থেকে

খলনায়কের কথা বলার আগে আরিয়ান মির্জার ব্যক্তিগত সহকারী জিল্লুর চরিত্রে অভিনয় করা স্যাম ভট্টাচার্যের কথা বলা যাক। কলকতার এই অভিনেতা দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, শাকিবের সঙ্গে পর্দায় তাঁর রসায়নও জমেছে বেশ। তাঁর উদ্দেশে শাকিবের বলা ‘জিল্লু, মাল দে’ সংলাপটি তো এখন রীতিমতো ভাইরাল।

খল চরিত্রে ফারহান হিসেবে পর্দায় যীশু সেনগুপ্তর প্রথম আবির্ভাব ছিল ভয়জাগানিয়া। দর্শক যখন আশায় আছেন এবার হয়তো সেয়ানে সেয়ানে টক্কর হবে, কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়েছে কমই। শাকিব-যীশুর টক্করটা চাইলে আরও জমাটি করতে পারতেন নির্মাতা। ভিলেন যত শক্তিশালী হবেন, নায়কের সঙ্গে তাঁর লড়াই তত জমবে, এ তো জানা কথাই। পরিচালক চাইলে চিত্রনাট্য নিয়ে আরও একটু ঘষামাজা করতে পারতেন, কিন্তু তিনি হয়তো চেয়েছেনই এভাবে বানাতে। চেয়েছেন এমন বড় আয়োজনের এক অ্যাকশন সিনেমা বানাতে, যা দেখতে দেখতে দর্শকের আর কিছু মনেই থাকবে না।

‘বরবাদ’ ছবির পোস্টারে শাকিব খান
‘বরবাদ’ ছবির পোস্টারে শাকিব খানফেসবুক থেকে

কয়েক বছর ধরেই ঈদের সিনেমার গানগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ‘বরবাদ’-এর গানগুলোও তেমনই হয়েছে। ‘দ্বিধা’ থেকে ‘মায়াবী’ দেখতে দারুণ লাগে। আলাদাভাবে বলতে হয় ‘মহামায়া’ গানের কথা। নোবেলের গাওয়া গানটি ছবির মেজাজের সঙ্গে মিশে গেছে। আইটেম গান ‘চাঁদ মামা’তে শাকিব আর নুসরাতের নাচে দর্শকের উচ্ছ্বাসও ছিল দেখার মতো।

‘বরবাদ’-এর বেশির ভাগ শুটিং হয়েছে দেশের বাইরে। তবে ছবিতে আলাদা কোনো দেশ বা শহরের প্রসঙ্গ আসেনি। লোকেশন এখানে গুরুত্বপূর্ণও নয়। সিনেমাটোগ্রাফিও খারাপ হয়নি। তবে আরাফাত মহসিনের আবহ সংগীত আরও রোমাঞ্চজাগানিয়া হতে পারত। কিন্তু ‘বরবাদ’ নিয়ে লিখতে গেলে অতি অবশ্যই ফারজানা সানের কথা লিখতে হবে। এই সিনেমায় কস্টিউমের দায়িত্ব দারুণভাবে সামলেছেন তিনি।

‘বরবাদ’–এ ইধিকা পাল। ভিডিও থেকে
‘বরবাদ’–এ ইধিকা পাল। ভিডিও থেকে

শুরুর আগে সিনেমার সার্টিফিকেশন নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে। সংলাপ আর পর্দায় দেখানো সহিংসতা নিয়ে কথা উঠেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনেমার রেটিং ‘ইউ/এ’! এর চেয়ে এটিকে ‘এ’ সনদ দিলেই হয়তো হতো। কারণ, সিনেমা দেখতে গিয়ে প্রচুর সংলাপে বিপ শুনতে বিরক্ত লাগে। সহিংসতার কিছু দৃশ্য ব্লার করা হয়েছে, তারপরও যা আছে, তাতে হলে শিশুদের না নিয়ে যাওয়াই ভালো।
ঈদের বিনোদননির্ভর সিনেমায় যা দরকার, তার সবই আছে ‘বরবাদ’-এ। শাকিব খানের সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টার ধুন্ধুমার অ্যাকশনজগতে আপনিও চাইলে ঢুকে পড়তে পারেন। এমন একটা ‘পয়সা উশুল’ সিনেমার পর পরিচালক মেহেদী হাসানের পরের কাজের জন্য অপেক্ষা করাই যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button